মহুয়ার দেশ রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর - Mohuar Desh Descriptive Question Answer

মহুয়ার দেশ রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর PDF: প্রতিবছর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় Mohuar Desh Descriptive Question Answer PDF থেকে অনেক প্রশ্ন আসে। তাই আমরা আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি মহুয়ার দেশ রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর PDF

মহুয়ার দেশ রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর - Mohuar Desh Descriptive Question Answer

নিচে মহুয়ার দেশ রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর PDF টি যত্নসহকারে পড়ুন ও জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি করুন। Mohuar Desh Descriptive Question Answer PDF পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ন।



মহুয়ার দেশ - সমর সেন


‘মহুয়ার দেশ’ কবিতাটি প্রখ্যাত সাহিত্যিক সমর সেনের ‘কয়েকটি কবিতা’ কাব্যগ্রন্থ থেকে গৃহিত হয়েছে। আলোচ্য পোস্টে সমর সেনের ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতার গুরুত্বপূর্ণ বহু বিকল্প ভিত্তিক প্রশ্ন (MCQ), অতিসংক্ষিপ্ত প্রশ্ন (SAQ), সংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্ন এবং রচনাধর্মী প্রশ্নগুলি তুলে ধরা হল।


মহুয়ার দেশ রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর - Mohuar Desh Descriptive Question Answer


1. “অনেক, অনেক দূরে আছে মেঘ-মদির মহুয়ার দেশ”—কবি ‘মহুয়ার দেশ’-এর কী বর্ণনা দিয়েছেন? এই ‘মহুয়ার দেশ’ কীভাবে কবির চেতনাকে প্রভাবিত করেছে, তা নিজের ভাষায় আলোচনা করো।

Ans. কবি প্রদত্ত মহুয়ার দেশের বর্ণনা: অন্য একটি কবিতায় সমর সেন লিখেছিলেন— “বৃষ্টির আভাসে করুণ পথে ধুলো উড়ছে, এমন দিনে সে ধুলো মনে শুধু আনে/সাঁওতাল পরগণার মেঘমদির আকাশ।” আলোচ্য কবিতাতেও দেখা যায় কবির কাছে মহুয়ার দেশ’ হল ‘মেঘমদির’। সেখানে সবসময় পথের দু-পাশে ছায়া ফেলে রহস্যময় দেবদারু গাছেরা। রাত্রির নিঃসঙ্গ নির্জনতাকে আলোড়িত করে ‘দূর সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাস’।

কবির চেতনায় ‘মহুয়ার দেশ: অবসন্নতা থেকে মুক্তি: ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতায় কবি সমর সেন নগরজীবনের ক্লান্তিকর অবসন্নতা থেকে মুক্তি খোঁজেন। কবির চেতনায় আসে মেঘমদির সুদূর মহুয়ার দেশ।

প্রকৃতির অনুষঙ্গ: গ্রামজীবনের নির্মল প্রকৃতির অনুষঙ্গ হিসেবে কবির কল্পনায় মাদকতাময় মহুয়া ফুলের আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। যে কবি লিখেছিলেন— “একদা শালবনে কেটেছে রোমান্টিক দিন”, তাঁর কবিতায় মহুয়ার দেশ’ হয়ে ওঠে বিবর্ণ শহরজীবনে ক্লান্ত মানুষের বেঁচে থাকার আশ্রয়। তার ক্লান্তির উপরে মহুয়া ফুল ঝরে পড়ুক, “নামুক মহুয়ার গন্ধ”—এটাই কবির আকাঙ্ক্ষা হয়ে ওঠে।

যন্ত্রসভ্যতার বিপন্নতাই: কিন্তু তাঁর স্বপ্নের মহুয়ার দেশেও হানা দেয়। যন্ত্রসভ্যতা। কবির কানে আসে মহুয়া বনের ধারের কয়লাখনির প্রবল শব্দ, শিশিরভেজা সবুজ সকালেও কবি দেখতে পান মানুষের শরীরে লেগে থাকা ধুলোর কলঙ্ক। নিদ্রাহীন এইসব মানুষের চোখে ভিড় করে আসা যন্ত্রসভ্যতার বিপন্নতাই কবির কাছে চূড়ান্ত সত্য হয়ে দেখা দেয়।


2. ‘মহুয়ার দেশ’ কোনো বাস্তবের দেশ নয়, স্বপ্নের দেশ—ব্যাখ্যা করো।

Ans. চল্লিশের দশকের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কবি সমর সেন যুগ ও জীবনের প্রতি অকপট স্বীকারোক্তি এবং ক্লান্তি-হতাশা-গ্লানির প্রতি রুদ্রচণ্ড হয়ে সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনকামী মতাদর্শে আস্থা জ্ঞাপন করেছেন। নগরজীবনের যা কিছু কুশ্রী ও বিকারগ্রস্ত তার থেকে মুক্তিলাভের জন্য কবি এমন এক স্থানের সন্ধান করেছিলেন যা পবিত্র প্রকৃতির রঙে ঠাসা। এমনই এক দেশ হল মহুয়ার দেশ। আপন কল্পনায় কবি মহুয়ার দেশ অর্থাৎ সাঁওতাল পরগনার নিসর্গ সৌন্দর্যকে অবলোকন করেছিলেন। সেখানে পড়ন্ত রোদের সন্ধ্যার জলে ‘গলিত সোনার মতো উজ্জ্বল আলোর স্তম্ভ’ নির্মাণ, ‘দেবদারুর দীর্ঘ রহস্য’, দূর সমুদ্রের রাত্রিকালীন দীর্ঘশ্বাস আর মহুয়া ফুলের মধুর সুবাস কবিকে চমকিত, পুলকিত করে।

কিন্তু এই অনুভূতি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কবি দেখেছেন সাঁওতাল পরগনার কোমল মনের মানুষগুলি কয়লাখনির শ্রমজীবীতে পরিণত হয়েছে। নিবিড় অন্ধকারে কবি শুনতে পান-


“মহুয়ার বনের ধারে কয়লার খনির

গভীর, বিশাল শব্দ,”


সেখানকার শ্রমক্লান্ত, অবসন্ন মানুষগুলোর শরীরে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন ধুলোর কলঙ্ক, তাদের ভবিষ্যৎ চিন্তায় নিদ্রাহীন নিশিযাপন করতে দেখেছেন। যন্ত্রসভ্যতার দাপটে সাঁওতাল পরগনার পবিত্রভূমিও কলুষিত।

আসলে ‘মহুয়ার দেশ’ কোনো বিশেষ স্থান নয়। ‘মহুয়া’ হল একপ্রকারের মদ যা পান করে মানুষ ক্ষণিকের জন্য বাস্তব জগতকে বিস্মৃত হতে পারে কিন্তু তার প্রভাব চিরস্থায়ী হতে পারে না। তাই মহুয়ার দেশও সুন্দরের এক ভ্রম মাত্র। বাস্তবের ধুলোর আঘাতে তার ঘোর সহজেই কেটে যেতে পারে। তাই কবিও এক স্বপ্নময় জগৎ কল্পনা করলেও যৌবনে দেখা স্বপ্ন বাস্তবের কঠোরতার সম্মুখীন হয়ে অচিরেই মুছে যায় এবং প্রমাণ করে দেয় যে, মহুয়ার দেশ শুধুই স্বপ্নময় দেশ, বাস্তবে তা অস্তিত্বহীন।


3. “ঘুমহীন তাদের চোখে হানা দেয়/কিসের ক্লাস্ত দুঃস্বপ্ন।”—’তাদের’ বলতে এখানে কাদের কথা বলা হয়েছে? তাদের নিদ্রাহীনতার কারণ কী? ক্লাস্ত দুঃস্বপ্ন’ বলতে কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন।

অথবা,

“ঘুমহীন তাদের চোখে হানা দেয়/কিসের ক্লাস্ত দুঃস্বপ্ন।” – কাদের কথা বলা হয়েছে? তাদের ঘুমহীন চোখে ক্লাস্ত দুঃস্বপ্ন হানা দেয় কেন? 

Ans. প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের আধুনিক কবি সমর সেনের লেখা ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতা থেকে উদ্ধৃত আলোচ্য পঙক্তি দুটিতে ‘তাদের’ বলতে মহুয়ার দেশের কয়লাখনিতে কর্মরত শ্রমিকশ্রেণির কথা বলা হয়েছে।

প্রকৃতির কোলে গড়ে ওঠা কয়লাখনির শ্রমিকরা দিবারাত্র কর্মরত থাকে। তা ছাড়া তাদের চোখে সদাজাগ্রত থাকে চির আপন জন্মভূমি থেকে অধিকার হারানোর বেদনা। মূলত, ভবিষ্যৎ জীবনের দুর্ভাবনা ও অধিকার হারানোর যন্ত্রণা—উভয় কারণেই তারা নিদ্রাহীন।

মহুয়ার দেশ প্রকৃতির সম্পদে পূর্ণ। এমন এক স্থানে খনিজ সম্পদকে কেন্দ্র করে প্রাচীন সভ্যতার বুকে পুঁজিবাদের একনায়কতন্ত্রের প্রসার ঘটলে সাঁওতাল পরগনার পাহাড় জঙ্গল অধ্যুষিত অঞ্চলের অধিবাসীগণ দিনমজুরে পরিণত হয়। ফলে তাদের জীবনে অধিকারহানির পাশাপাশি অনিশ্চয়তার আশঙ্কাও বাসা বাঁধতে থাকে। ধনতন্ত্রের আগ্রাসনের দ্বারা সর্বাধিক প্রভাবিত হয় তাদের চিরাচরিত জীবনব্যবস্থা ও স্বতঃস্ফূর্ততা। মহুয়ার ফুল তার মেঘ-মদির সুবাস সহযোগে তাদের ক্লান্তির উপর ঝরে পড়তে পারে না, হারিয়ে যেতে শুরু করে দেবদারু বৃক্ষের ‘দীর্ঘ রহস্য’। পরিবর্তে শুধু শোনা যেতে থাকে নিবিড় অন্ধকারে ডিনামাইট বিস্ফোরণের ভীষণ, জলদগম্ভীর শব্দ। অবসন্ন শরীরে বিনিদ্র রাত্রিযাপন করে খনিশ্রমিকরা। বিনিদ্র রাত্রে পাহাড়-জঙ্গল নদনদীর উপর থেকে নিজেদের চিরাচরিত অধিকার হারানোর দুশ্চিন্তা, ভবিষ্যৎ জীবন সম্পর্কে আশঙ্কা তাদের জীবনে দুঃস্বপ্নের আকারে ফিরে ফিরে আসে। কবি প্রতিবাদহীন এই মূর্তি সদৃশ মানুষগুলির দুঃস্বপ্নকে ক্লান্ত বলেছেন।


4. ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতায় কবি সমর সেনের প্রকৃতিপ্রেম কীভাবে প্রকাশিত হয়েছে তা ব্যক্ত করো।

Ans. কবি সমর সেন জনগণের প্রাণের কথা শুনতে অভিলাষী। এই অভিলাষই তাকে প্রকৃতি ও রোমান্টিকতা থেকে দূরে সরিয়ে কঠিন-কঠোর বাস্তবতার স্তুতিগান রচনায় অনুপ্রাণিত করেছে। তবে যুবক কবির মন থেকে প্রকৃতির প্রতি অনুরাগ সম্পূর্ণ রূপে মুছে যেতে পারেনি। আলোচ্যমান ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতার মধ্যেও তাই প্রকৃতির প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে অবক্ষয়িত নগরসভ্যতাকে ভুলে যাওয়ার বাসনায়।

কবি সমর সেন সাঁওতাল পরগনার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ শতই কল্পনার দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছেন তাঁর কলুষতামুক্ত কোমল রূপটিকে। কবি সেখানে সন্ধ্যার জলস্রোতে এক ভিন্ন ধরনের সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করেছেন। কল্পনাবিলাসী কবি


“অলস সূর্য দেয় এঁকে

গলিত সোনার মতো উজ্জ্বল আলোর স্তম্ভ”


সাঁওতাল পরগনায় অলস সূর্যের ম্লান আলোর প্রতিফলনে স্কুলের অন্ধকারে ধূসর ফেনায় আগুন লাগে। মহুয়ার দেশে ধোঁয়ার বঙ্কিম নিশ্বাস, দূর সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাস ঘুরে ফিরে কবির। ঝাছে ফিরে এসে কবির একাকিত্বকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দেয়। তবে কবির কাছে সেই ধোঁয়ার বঙ্কিম নিশ্বাস কখনোই অভিপ্রেত নয়, কারণ তা প্রকৃতির স্নিগ্ধ অবয়বে কলুষতার কালিমা লেপন করে।

প্রকৃতির প্রতি কবির অমোঘ টানের অনুষঙ্গে এই কবিতায়। একর পর এক চিত্রকল্পের আগমন ঘটেছে। সিন্ধ্যার জলস্রোত, অলস সূর্য’, ‘জলের অন্ধকারে ধূসর ফেনা’, ‘দেবদারুর রহস্য’, ‘সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাস’ কিংবা ‘শিশিরভেজা সবুজ সকাল’–এইসব চিত্রকল্পগুলির প্রয়োগে প্রকৃতি যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কবির ভাবনায় ও তার সৃজনীশক্তির দক্ষতায় প্রকৃতি হয়ে উঠেছে বিচিত্র রূপময়।


5. “আমার ক্লান্তির উপরে ঝরুক মহুয়া-ফুল,/ নামুক মহুয়ার গন্ধ।”-কবির কী কারণে ক্লান্তি? সেই ক্লান্তি কীভাবে দূরীভূত হতে পারে বলে কবি মনে করেন?

Ans. ক্ষয়িয়ু মধ্যবিত্ত জীবনের বিষণ্ণতায় কবিমন ক্লান্ত তাই শহরের যান্ত্রিকতা ছেড়ে তিনি শান্তির খোঁজে গ্রামীণ জীবনে প্রবেশ করতে চান। যুগ ও জীবনের ক্লান্তি কবির বিভিন্ন রচনায় প্রত্যক্ষ করা যায়—


“মহানগরীতে এল বিবর্ণ দিন, তারপর আলকাতরার

 মতো রাত্রি আর দিন

সমস্ত দিন ভরে শুনি রোলারের শব্দ।”


ক্লান্ত, অবসন্ন দেহচেতনা ও মানসিক বৈকল্য ঘোচাতে কবি সাঁওতাল পরগনার শান্ত-স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের বুকে বিচরণ করতে চেয়েছেন-


 “অনেক, অনেক দূরে আছে মেঘ-মদির মহুয়ার দেশ”


কবি সেই উদাত্ত প্রকৃতির বুকে অবগাহন করে মনের ক্লান্তি দূর করতে চান। সেখানে মহুয়া আর দেবদারুর সুদীর্ঘ রহস্যঘেরা মায়াজাল কবিকে আকর্ষণ করে সুদূর নীলিমায়। দূর সমুদ্রের গর্জন রাত্রির নিরালা ও নিঃসঙ্গতাকে দূরে সরিয়ে দেয় সরব উপস্থাপনায়। মধ্যবিত্ত জীবনের চলার গতি থেকে কবিমন ক্লাস্ত। সেই একঘেয়েমির বৃত্তবলয় ভেঙে কবি তাঁর লালিত বিশ্বাসের বৃত্তচ্যুত হয়ে এক আশার জগতে উত্তীর্ণ হয়েছেন। সে কারণে উদার উন্মুক্ত প্রকৃতির প্রাঙ্গণে অনুপম সৌন্দর্যের আহ্বান কবিকে তাড়িত করেছে। তার সারা শরীরের ক্লান্তি অবসাদ দূর করতে মহুয়ার সৌন্দর্য চেতনা দ্বারা তিনি সিক্ত হতে চান।


6. “গলিত সোনার মতো উজ্জ্বল আলোর স্তম্ভ” –কার লেখা কোন্ কবিতার অংশ এটি? উদ্ধৃতিটির প্রসঙ্গ উল্লেখ পূর্বক নিহিতার্থ লেখো।

Ans. উদ্ধৃত চরণটি আধুনিক কবি সমর সেনের ‘মহুয়ার দেশ’ কবিতার প্রারম্ভিক অংশ। কবি সমাজ সভ্যতার দুটি রূপের অন্তরালে লুক্কায়িত প্রকৃত সত্য উদ্‌ঘাটনে প্রয়াসী হয়েছেন বারেবারে। একদিকে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার অন্তরালে মানুষের উপরে নেমে আসা অত্যাচার ও গ্লানি ভয়ংকরতম রূপ লাভ করে, অপরদিকে সমাজের বৃহত্তর অংশই বঞ্ছনা ও পীড়নের শিকার। এরূপ দ্বন্দ্বসংঘাতের ঐতিহাসিক সত্য নিরূপণের পাশাপাশি কবি মধ্যবিত্ত সমাজজীবনের কদর্য রূপটি প্রত্যক্ষ করে তা থেকে উত্তরণের জন্য এবং শান্তি লাভের আশায় উদার প্রকৃতির অপরূপ লাবণ্যমাখা মহুয়ার দেশ সাঁওতাল পরগনায় উপনীত হয়েছেন। একদিকে প্রকৃতির উদ্দামতা আর সেখানের কর্মমুখর মানুষের শ্রমক্লান্ত জীবন কবিকে আকৃষ্ট করে, প্রাণিত করে। শাল-মহুয়া-দেবদারুসহ অগণিত বৃক্ষসমূহের সমারোহে সেখানকার বনভূমি লীলাচল সৌন্দর্যের আধার। কবি সেখানে দাঁড়িয়ে দিনরাত্রির সন্ধিক্ষণে সূর্য অস্তমিত হওয়ার মুহূর্তে সমুদ্রের ঢেউয়ের উপর আলোর যে লীলাখেলা চলছিল তা উপভোগ করেন। অস্তাচলগামী অলস সূর্য গলে যাওয়া সোনার মতো উজ্জ্বলতর আলোকস্তম্ভ তৈরি করে প্রকৃতির বুকে। শুধু তাই নয়, সূর্যের আলোর সোনালি আভা দিগন্তকে উদ্ভাসিত করে তোলে। দিনান্তের সেই শেষ রশ্মিপাত সাগরের বুকের ঢেউয়ে যেন আগুন লাগায়। বস্তুবাদী কবির মনে দিনের শেষলগ্নের সূর্যের আভা ম্লান হয়ে দেখা দেয়নি, বরং প্রভাতের আগমনি বার্তা বয়ে নতুন দিনের স্বপ্ন চয়নে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠতে থাকে।

জীবনের চলমান ধারায় কর্মমুখর জনতার অক্লান্ত শ্রমদান সভ্যতার বুকে নতুন আলোর রোশনাইয়ের বিচ্ছুরণ ঘটায়। কবির দৃষ্টিপথে কর্মমুখর জনতার কর্মধারা উজ্জ্বল আলোকের মতো দিগন্তজোড়া বিস্তৃতিতে ধরা দেয়। সর্বোপরি, প্রেম ও নাগরিকতার ক্লান্ত নৈরাশ্যজনক অনুভূতি থেকে এক চূড়ান্ত আশাবাদ ঘোষিত হয়েছে সোনার উজ্জ্বলতর চাকচিক্যে। বর্তমান যতই দুর্বিষহ ও যন্ত্রণাকাতর হোক এবং ভবিষ্যৎ যতই অনিশ্চয়তায় ভরা থাক তবু নতুন আলোয় নতুন দিনের স্বপ্ন রচনা করেছেন কবি।


7. 'ধোঁয়ার বঙ্কিম নিঃশ্বাস ঘুরে ফিরে ঘরে আসে / শীতের দুঃস্বপ্নের মতো।'- প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তাৎপর্য বিশ্লেষণ কর। 

Ans. সৌন্দর্যের ক্ষণস্থায়িত্ব: আলোচ্য উক্তিটি নাগরিক কবি সমর সেনের 'কয়েকটি কবিতা' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত 'মহুয়ার দেশ' কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে।  কবি আলোচ্য কবিতায় প্রথম পর্বে শহর সভ্যতার দূষণপূর্ণ পরিবেশে অস্তগামী সূর্যের স্বর্ণালী আলোয় রচিত বঙ্গপ্রকৃতির সন্ধ্যাকালীন সৌন্দর্যকে ক্ষণস্থায়ী বোঝাতে আলোচ্য উক্তিটি অবতারণা করেছেন। 

কবির মুক্তি কামনা: কবি আলোচ্য কবিতায় দেখিয়েছেন অস্তগামী সূর্যের স্বর্ণালী আলোর তির্যক আভায় যখন জলতলে নির্মিত হয় 'উজ্জ্বল আলোর স্তম্ভ', আর সেই আলোয় যখন জলের উপর ভাসমান ফেনায় লাগিয়ে দে আগুন রং ; তখন কবির মন মুগ্ধ হয়ে যায় শহরের এই সন্ধ্যার স্নিগ্ধ পরিবেশে। কিন্তু এই স্নিগ্ধতা বেশিক্ষন স্থায়ী হতে পারে না। প্রকৃতির এই অনাবিল সৌন্দর্য নিমেষেই ঢাকা পরে যায় প্রগতির বিলাসিতার কারণে তথা দূষণে। তাই 'ধোঁয়ার বঙ্কিম নিঃশ্বাস' কবির চেতনাকে চারপাশ থেকে চেপে ধরে , কবির মুগ্ধ দৃষ্টিকে অনাবিল করে দেয়।  শিল্প-সভ্যতার দাপটে আপাত নিরীহ শীতের ঘুমের মতো নাগরিক সন্ধ্যার সৌন্দর্যে মুগ্ধ কবিমনে হানা দেয় দূষণ ,দুঃস্বপ্নের মতো।  নাগরিক বহমান জীবন থেকে লড়াই করতে করতে যে শান্তির খোঁজ কবিমন করেছিল , তা সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কবির কাব্য ক্যানভাসে জমা হয় বিষাদ আল্পনা।  শহরের অনিয়ন্ত্রিত দূষণ কবিকে মুক্তিকামী করে তোলে, কবির স্বপ্নের স্বচ্ছ শহর ঢাকা পড়ে যায় দুঃস্বপ্নের ধোঁয়াশায়। 


8. 'অনেক দূরে আছে মেঘ-মদির মহুয়ার দেশ,'- কবির দেখা মহুয়ার দেশটি কেমন তা কবিতা অবলম্বনে বর্ণনা করো। 

Ans. কবির কাম্য-দূষণমুক্ত পরিবেশ:  'কয়েকটি কবিতা'কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত 'মহুয়ার দেশ' কবিতাটি কবি সমর সেনের অধিকাংশ কবিতার মেজাজ থেকে অনেকটা আলাদা। নগরজীবনের একঘেয়েমি ও ক্লান্তি থেকে মুক্তি পেতে কবির মন যে মহুয়ার দেশে আশ্রয় খুঁজেছে ,সে দেশ অনাবিল পরিচ্ছন্নতার স্বর্গরাজ্য। অনেক দূরের সেই 'মেঘ-মদির' মহুয়ার দেশ কবির কাছে চির আকর্ষণীয়। সেখানে ' দেবদারুর দীর্ঘ রহস্য ' 'পথের দুধারে ছায়া ফেলে' 'সমস্তক্ষণ'। সেখানে 'দূর সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাস' 'রাত্রের নির্জন নিঃসঙ্গতাকে আলোড়িত করে'। দূষণমুক্ত প্রকৃতির এই স্নেহময় আবেশ ক্লান্ত ও অবসন্ন শহুরে কবির কাছে তাই কাঙ্ক্ষিত হয়ে দাঁড়ায়। 

প্রাকৃতিলগ্ন জীবন: কালের পরিবর্তনের সঙ্গে কবির সেই পরমাকাঙ্ক্ষিত মহুয়ার দেশের ওপর নেমে আসে ধনতন্ত্রের থাবা। প্রগতির হিংস্রতা থেকে রক্ষা পায় না উদার,উন্মুক্ত প্রকৃতি।  মহুয়ার দেশেও 'নিবিড় অন্ধকারে ' শোনা যায় বেমানান কয়লা খনির 'গভীর ,বিশাল শব্দ'। নাগরিক জীবনের দূষিত ক্লান্তির মতোই কবির কাছে সে 'শব্দ' অসহ্য ঠেকে।  জীবনযন্ত্রণা ,জীবনযাপনের ক্লান্তি এসমস্ত কিছুই আসলে কোনো নির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমায় আবদ্ধ নয়। তাই মহুয়ার দেশের 'শিশির-ভেজা সবুজ সকালে'-ও মানুষের শরীরে থেকে 'ধুলোর কলঙ্ক'। মহুয়ার দেশকে খুব কাছ থেকে দেখে কবি উপলব্ধি করেন সেখানকার প্রাকৃতিলগ্ন জীবনে ক্লান্তহীন একমাত্রিক পরিতৃপ্তি ছাড়াও রয়েছে পুঁজিবাদী সভ্যতার আগ্রাসন এবং মানবিক সত্তার  অবক্ষয়। প্রগতির কাছে প্রকৃতির এই অসহায় আত্মসমর্পন প্রতিষ্ঠতা করে মহুয়ার দেশে বেঁচে থাকতে পারে কবির স্বপ্নে আর সত্তায়। 


Google News এ আমাদের ফলো করুন


Gksolves Google News


ঘোষণা: বিনামূল্যে আমাদের দেওয়া নোটস, সাজেশান, প্রশ্ন উত্তর ইত্যাদি স্টাডি ম্যাটেরিয়াল PDF এবং ভিডিও ক্লাস ভালো লাগলে, আমাদের এই পোস্টের লিংক আপনার বন্ধুদের ফেসবুকWhatsApp এ শেয়ার করে তাদের পড়ার সুযোগ করে দিন।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Ads Area